শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নাসিমা আক্তার (২৫) নিজেকে পরিণত করেছেন দক্ষ শ্রমিক হিসেবে। নিজের মেধা আর অদম্য ইচ্ছা দিয়ে তিনি জয় করেছেন শারীরিক বাধা।
সাভারে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অবস্থিত শান্তা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের তৈরি পোশাক কারখানার স্ইং অপারেটর নাসিমা আক্তার এখন কারখানার সবার প্রিয় মুখ। শ্রমিক থেকে মালিক সবাই তাকে ভালোবাসে। তাঁর নিপুণ কর্ম-উদ্দীপনা আজ অনেকের প্রেরণার উৎস।
মাত্র ৫ বছর আগেও নাসিমার ছিল অন্য এক জীবন। তিন বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে দুটি পা অবশ হয়ে যায় তার। নিজের কাছেই বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তার জীবন। তার জীবনবদলের নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বখ্যাত পোশাক-ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার’।
সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির মার্কস অ্যান্ড স্টার্ট প্রকল্প তাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নিয়ে আসে জীবনের মূল স্রোতে।
পাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) গণকবাড়ি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ শেষে আজ সে দক্ষ শ্রমিক। আর দক্ষতার স্বীকৃত হিসেবেই কাজ করছেন নামী একটি তৈরি পোশাক কারখানায়।
কেবল নাসিমাই নন, তার মতো ৩১৬ প্রতিবন্ধী শ্রমিক ‘মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের’ সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ কাজ করছেন দেশের ৩৩টি তৈরি পোশাক কারখানায়।
প্রতিবন্ধী হয়েও তৈরি পোশাক কারখানায় কীভাবে নিজের দক্ষতার স্বার রাখছেন তারা আর তাদের ব্যাপারে পোশাক কারখানার মালিক বা অন্য শ্রমিকদেরই বা কী ধারণা, সেই অভিজ্ঞতা-বিনিময়ের উদ্দেশে সিআরপি ও মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের যৌথ উদ্যোগে সিআরপিতে ২৬ জানুয়ারি বুধবার আয়োজন করা হয় বার্ষিক আনন্দ সমাবেশের।
‘প্রতিবন্ধকতা মানে কাজের অমতা নয় এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পৃথিবীর উন্নয়নে অপাঙক্তেয় নয়’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছিল প্রতিবন্ধীদের জীবন জয়ের উৎসব।
দক্ষ প্রতিবন্ধীদের এ আনন্দ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের কান্ট্রি ডিরেক্টর নাজিব সাঈদ, একই প্রতিষ্ঠানের সিএসআর-এর (সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম) পরিচালক রিচার্ড গিলস, ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাংসদ শাহরিয়ার আলম, সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়কারী মিস ভেলরি এ. টেইলর।
নাজিব সাঈদ বাংলানিউজকে জানান, সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টায় সম্পৃক্ত হতে পেরে তার প্রতিষ্ঠান গর্বিত। সামগ্রিক উন্নয়নে অবহেলিত প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে থাকবে মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার।
রিচার্ড গিলস বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষদের পাশ কাটিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের প্রকল্প প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষদের সমাজের উৎপাদনম অংশে অন্তর্ভুক্ত করেছে, দূর করেছে তাদের হতাশার গ্লানি ।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সামান্য সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীরাও যে সমাজের বোঝা থেকে সম্পদে পরিণত হতে পারেন, এর প্রমাণ এ উৎসবে যোগ দেওয়া তিন শতাধিক প্রতিবন্ধী। ’
ভেলরি এ. টেইলর বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের স্বপ্ন পূরণে তাদের স্বনির্ভরতা অর্জন দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার জন্যে একটি ভালো খবর।
সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
পোশাক শ্রমিক নাসিমা আক্তার জানালেন, এই প্রকল্প তাকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজ আমি দেশের একটি ভালো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, আমার সংসার হয়েছে এবং আমি আমার পরিবারের সবার কাছে মূল্যায়ন পাই।
নাসিমার এ কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল ইন্টারফেব শার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং নামের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক প্রতিবন্ধী জান্নাতুল সুমী, নাসরিন আক্তার ও রাবেয়া আক্তারের মুখেও। তারা জানালেন, আমরাও পারি সমাজকে অনেক কিছু দিতে। সমাজের সময় এসেছে আমাদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবার।
পরে প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরার পরিচালনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিবন্ধীদের বাস্কেটবল খেলার আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ সময় ১৮৪৫, জানুয়ারি ২৬, ২০১১