ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: সকাল সাড়ে ৮টা। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগ।
ভরে গেছে রোগীদের নির্ধারিত বসার আসনও। টিকিট না থাকায় ঘণ্টাখানেক বিলম্বে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা বর্হিবিভাগের দু’একজন চিকিৎসকও এ অজুহাতে রোগীদের সেবাও দিচ্ছেন না। নিজেদের কক্ষ থেকে বের হতেই ‘পঙ্গপালের’ মতো তাদের ঘিরে ধরছেন রোগীরা। কখন আসবেন টিকিট মাস্টার, কখন ছাড়বে টিকিট ইত্যাকার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন।

undefined
ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে ১০টার ঘরে পৌঁছার পর শেষতক যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার অবসান ঘটলো। পড়িমরি খেয়ে কাউন্টারের তালা খুললেন একজন। নাম তার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি টিকিট মাস্টার। তাকে পেয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকা রোগীদের মাঝে শুরু হলো হুড়োহুড়ি। তেঁতিয়ে উঠতেও দেখা গেলো কোনো কোনো রোগীকে।
এ উপজেলার প্রায় ৫ লাখ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শনিবারের (২০ ফেব্রুয়ারি) দৃশ্য ছিল এমনই। শুধু কী টিকিট মাস্টারই বিলম্বে আসেন তা কিন্তু নয়। বহির্বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত ৫ থেকে ৬ জন চিকিৎসকেরও অফিস টাইম শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা খানেক কিংবা দেড়েক পর।
সময় না মানার এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) নজরুল ইসলামও। সেদিন এ চিকিৎসক নিজের ১৩ নম্বর কক্ষের তালা খুলেছেন সকাল ১০টার পর। যখন তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন তখন সঙ্গী হলো একটি ওষুধ কোম্পানির দু’প্রতিনিধি।

undefined
নিজেদের মাঝে মিনিট পাঁচেক আলোচনার পর আবারো কক্ষে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন নজরুল ইসলাম। বেশ কয়েক রোগী তার দিকে এগিয়ে এসে নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরতেই তার মুখ ভার। পাশে থাকা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি মাহফুজ ওই চিকিৎসকের পক্ষ হয়ে বললেন, ‘কাউন্টার খুললে টিকিট কেটে পরে আসবেন। ’
সকাল সাড়ে ১০টার কিছু সময় আগে আসেন চিকিৎসক হারুন আল মাকসুদ। তখনো তার সামনের ও আশেপাশের কক্ষের চিকিৎসক এমজি মোস্তফা, তাজুল ইসলাম, মাজাহারুল ইসলাম ও জাকির হোসেন জিকু কক্ষে তালা ঝুলছে। একই অবস্থা ছিল ল্যাবরেটরি, ইসিজি ও ওষুধ প্রদানকারী ফার্মাসিস্টের কক্ষেরও। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কক্ষ খোলা থাকলেও ছিল ফাঁকা।
বহির্বিভাগে আসা রোগীদের অভিযোগ, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এটি শুধু একদিনের নয়, নিত্যদিনের চিত্র। তাদের ফাঁকিবাজি ও গাফিলতির কারণেই প্রতিদিন গড়ে এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ৪ থেকে ৫শ’ রোগীকে রীতিমতো ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়।

undefined
বহির্বিভাগে দাঁড়িয়ে কথা হয় উপজেলার বাক্তা ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের আলী হোসেন (২২), কুশমাইল এলাকার আব্দুল মোতালেব (৪০), ফরিদা (২৫) ও তেলিগ্রাম বাজার এলাকার জালাল উদ্দিনের (৩৫) সঙ্গে। চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে তারা এসেছেন। সকাল ৮টা থেকেই অপেক্ষা করছেন টিকিট কাউন্টারের সামনে। কিন্তু কাউন্টারম্যান ও চিকিৎসকরা না আসায় ক্ষোভে ফুঁসছিলেন তারা।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম শুরু হওয়ার নিয়ম থাকলেও চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই নিয়ম মানছেন না। নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দেড়েক কিংবা দু’য়েক পর শুরু হয় এখানকার যাবতীয় কার্যক্রম।
অথচ উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে অনেক আগেই চিকিৎসা সেবার জন্য এখানে এসে ভিড় করেন রোগীরা। লাঞ্চের পর অনেক চিকিৎসককে আর নিজেদের কক্ষে পাওয়া যায় না। অফিস ফাঁকি দিয়ে এ সময় তারা স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিক ও প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসে রোগী দেখে টাকা গুনে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরেন।

undefined
স্থানীয় পলাশতলী এলাকা থেকে আসা মোশাররফ হোসেন (৩০) ক্ষোভ নিয়ে বলেন, এ হাসপাতাল শুধু নামেই। এখানে ঠিক সময়ে চিকিৎসকদের যেমনি পাওয়া যায় না তেমনি প্যারাসিটামল আর অ্যান্টাসিড ছাড়া কোনো ওষুধও দেওয়া হয় না। বাইরে থেকে টাকা দিয়েই সব ওষুধ কিনতে হয়।
সরেজমিনে সকাল থেকে দুপুর নাগাদ এ হাসপাতালে অবস্থান করে জানা গেলো, এখানকার গাইনী বিভাগের সার্জন ডা. মুশাহিদা আন নূর রেণু’র কক্ষ সপ্তাহ দু’য়েক ধরেই তালাবদ্ধ। বেলা ১১টার পর এ কক্ষের তালা খুললেন কামরুন নাহার নামের একজন। জানালেন, নিজের মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার জন্য এক মাসের ছুটিতে আছেন এ চিকিৎসক।
ছুটির সময় বাদে তিনি সপ্তাহে ক’দিন হাসপাতালে আসেন, জানতে চাইলে যেন খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকাই খেলেন কামরুন। একটু নীরব থেকে বললেন, ‘ম্যাডাম সপ্তাহে চারদিন অফিস করেন। আর দাঁতের ডাক্তার নার্গিস ম্যাডামও মাঝে মধ্যে আসেন না’।

undefined
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অবস্থাও বেহাল। বেলা ১১টার দিকে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের একাই সামলাতে দেখা গেলো উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হাসান আল মামুনকে। অন্য চিকিৎসকরা কোথায়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দু’জন চিকিৎসক বহির্বিভাগে গেছেন’।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের বেলায় জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবা মিললেও রাতের বেলায় কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। এ সময় হাসপাতালের ব্রাদাররাই সামলান এ বিভাগ। নামমাত্র চিকিৎসা দিয়ে বেশিরভাগ রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালের চিকিৎসকদের কক্ষে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবস্থান করার নিয়ম না থাকলেও এক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটছে প্রতিনিয়তই। সকালেই এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে এসব প্রতিনিধিরা দলবেধে কারণে-অকারণে হানা দেন চিকিৎসকদের কক্ষে।

undefined
এর সঙ্গে আছে বেসরকারি ক্লিনিক প্রতিনিধিদেরও উৎপাত। এ দু’শ্রেণির প্রতিনিধির কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকিট হাতে অপেক্ষায় থাকতে হয় রোগীদের, অভিযোগ কুলসুম ও জালাল নামের দু’রোগীর।
এসব বিষয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আতাউল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, সকাল সাড়ে ৮টায় টিকিট কাউন্টার খোলার নিয়ম রয়েছে। টিকিট মাস্টার এ নিয়ম ভাঙলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিকিৎসকদের ফাঁকিবাজি ও গড় হাজিরার বিষয়ে তিনি বলেন, সবসময় নৈতিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করে আসছি। গড় হাজিরার জন্য মাস দু’য়েক আগে চার চিকিৎসককে শোকজ করা হয়। আমি নিয়ম-কানুনের মধ্যেই হাসপাতালটি পরিচালনা করার চেষ্টা করে আসছি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
এমএএম/জেডএস