ঢাকা, বুধবার, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ জুলাই ২০২৫, ২৭ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

সুরক্ষিত জলাঞ্চল যেন জলে না যায় ।। মোহাম্মদ আরজু

সমুদ্র প্রতিরক্ষা/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৪৬, নভেম্বর ২১, ২০১৪
সুরক্ষিত জলাঞ্চল যেন জলে না যায় ।। মোহাম্মদ আরজু

চতুর্দিকে সমুদ্রের স্বর। লাইনটা বেশ ক’মাস ধরে মাথার ভিতর গেঁথে আছে।

হয়তো জীবনানন্দের অপভ্রংশ। ‘অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর’; লিখেছিলেন বিপন্ন বিস্ময়ের কবি। অথচ আমার মনে হয় বুঝি বা ‘চতুর্দিকে’ই লিখেছিলেন জীবনানন্দ। টের করি; বঙ্গোপসাগরের প্রবাল বসতির সীমানা শনাক্ত করতে গত দুই বছর ধরে চলা জরিপ ও গবেষণায় থেকে থেকে, সাগরে ডুবসাঁতারে ডুবতে ডুবতে সমুদ্র মাথার ভিতরই ঢুকে আছে। এমনতরো এক রাতেই সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনসে বসে এক বার্তা পেলাম। শুভ বার্তা। বঙ্গোপসাগরে সুরক্ষিত জলাঞ্চলের যাত্রা শুরুর বার্তা।

সম্প্রতি দুই প্রতিবেশি দেশের সাথে আমাদের সমুদ্রসীমানার আইনগত নিষ্পত্তির কালে জাতীয় পরিসরেও চতুর্দিকে সমুদ্রের স্বর শুনতে পাই। ভালো লাগে। এরই মধ্যে, বঙ্গোপসাগরে ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা ‘মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করেছে সরকার। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২’র ১৩ (১) এবং (১৩) ২ ধারার ক্ষমতা বলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২৭ অক্টোবর এই পরিপত্র জারি করে। সামুদ্রিক গভীর গিরিখাত— ১৪ কিলোমিটার চওড়া ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ ঘিরে এই সুরক্ষিত জলাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে জলের গড় গভীরতা ৯০০ মিটার।  

সুন্দরবনের দক্ষিণাংশে দুবলার চরের কাছাকাছি থেকে শুরু হয়েছে এই অঞ্চলের সীমানা, এর পশ্চিমে রয়েছে ইনডিয়ার জলসীমা। বলা হয়েছে, এখানে মাছ ধরা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বাধা-নিষেধ থাকবে।   এখানে জলাঞ্চলকে সুরক্ষিত ঘোষণা করার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক ‘ওয়াইল্ডলাইভ কনজারভেশন সোসাইটি’র পর্যবেক্ষণের বরাতে ২ নভেম্বর মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এটি বঙ্গোপসাগরে ডলফিন, তিমি, হাঙ্গর এবং সামুদ্রিক কচ্ছপের একমাত্র প্রজনন ক্ষেত্র। এই এলাকা বিশ্বের কমপক্ষে পাঁচটি বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন এবং আট প্রজাতির তিমির প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র।

undefined



বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের সংশ্লিষ্ট অংশে বলা রয়েছে; “জাতীয় বননীতি ও বন মহাপরিকল্পনার আলোকে এবং প্রকৃতি, ভূমিগঠনগত বৈশিষ্ট্য, জীববৈচিত্র্য বা পরিবেশগত গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া কোনো সরকারি বন, বনের অংশ, সরকারি ভূমি, জলাভূমি বা যেকোনো নির্দিষ্ট এলাকাকে বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের নিমিত্ত সুনির্দিষ্টভাবে সীমানা নির্ধারণপূর্বক, অভয়ারণ্য ঘোষণা করিতে পারিবে। ” এবং “ঘোষিত অভয়ারণ্যকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, পাখি অভয়ারণ্য, হাতি অভয়ারণ্য বা জলাভূমি নির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য, বা ক্ষেত্রমত, মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসাবে নির্ধারণ করা যাইবে। ”

এই আইনের ক্ষমতা বলে ঘোষিত ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’ বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ঘোষিত প্রথম সুরক্ষিত জলাঞ্চল। এই ঘোষণা, শুভ বার্তা, সন্দেহ নাই। তবে যেভাবে এই ‘ঘোষণা’ এসেছে, তাতে এই ভয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই ঘোষণা জলে যেতে পারে। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও আগ্রহের পরেও জাতীয় পর্যায়ে নানা সীমাবদ্ধতার কারণেই এই উদ্যোগটি প্রায় প্রস্তুতিহীনভাবেই এসেছে। এইটে খুব ভয়ের কারণ।

এই ঘোষণাকে কাজে রূপ দিতে আগেই দরকার ছিলো নীতিগত, পরিকাঠামোগত ও অবকাঠামোগত শক্ত প্রস্তুতির ভিত। সাগরে ঠিক কোথায় সুরক্ষিত জলাঞ্চল দরকার—তা কিভাবে ঠিক করা হবে—যাচাই-বাছাই-গবেষণা; জলাঞ্চল ঘোষণা হলে পরে তা কিভাবে ব্যবস্থাপনা করা হবে—সব স্থির করা ছাড়া, সুস্পষ্ট নীতি ও পরিকাঠামো ছাড়া এমন ঘোষণা কাজে আসবার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? এইসব দিকে মোটেই নজর না দিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড পার্ক কংগ্রেসের’ দিন কয়েক আগে ভাগে এমন ঘোষণা ‘প্রথমে’র চমক ছাড়া আর কি দেবে?

কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মনোভঙ্গিও বিপদের কারণ হতে পারে। মন্ত্রণালয়ের বরাতে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ‘এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের জলসীমায় কিছু বিপন্ন প্রজাতির মূল্যবান প্রাণীর অবাধ বিচরণ ও প্রজননও নিশ্চিত হলো। ’ এটা কিছু হলো? ঘোষণাই একেবারে নিশ্চিন্ত? তবে দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অতীতে এভাবে ঘোষণা দিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিন্তে আছেন। প্রায় দেড় দশক আগে দেশের বেশ কিছু এলাকাকে ‘প্রতিবেশগভাবে সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা দেয়া হয়, ওই ঘোষণাই সার, আজতক এসব এলাকার সুরক্ষায় ‘বিধিমালা’ করা যায়নি। এইদিকে ওইসব সঙ্কটাপন্ন এলাকার অবস্থা বেগতিক হতে হতে এখন ওসবের প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্য বিলুপ্তির পথে।

undefined



যেমন সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ। এ দ্বীপের প্রধানতম প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর চারপাশে সাগরে প্রবাল ও শৈবাল বসতি। সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হলেও এই প্রবাল-শৈবাল বসতিকে কোনো সুরক্ষার আওতায় আনা হয়নি আজও। দুই দশকের পরিবেশ-বিধ্বংসী পর্যটনের বাড়াবাড়িতে এখন সেখানে প্রবাল বসতির ধ্বংসাবশেষই রয়েছে মাত্র। কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা বা আইনগত সুরক্ষা নেই প্রাণবৈচিত্র্যের। অথচ সংশ্লিষ্টরা এখনো দাবি করেন, ‘সেন্ট মার্টিনস প্রতিবেশগতভাবে সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষিত একটি প্রটেক্টেড এরিয়া’। খুবই অসত্য বিবৃতি!

এরপরও আমরা আশাবাদী হতে চাই। কারণ, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আন্তরিক ও আগ্রহী নেতৃত্ব রয়েছে। স্রেফ ফলদায়ক কাজের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির অনুসরণের জন্য নীতিগত ও বৈষয়িক সামর্থ্য অর্জন করা দরকার। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশল, ২০১৫-২০১০ গ্রহণ করেছে। সামুদ্রিক অর্থনীতিকে এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজনীয় নীতিগত ও বৈষয়িক সামর্থ্য তৈরিতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।  

‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’র বিষয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব নজিবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “বিরল ও বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলে সারা বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। এই এলাকাটিকে আধুনিক মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা হবে। ”

এইটেই জরুরি। বঙ্গোপসাগরে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ সামুদ্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে বাংলাদেশের যে প্রতিশ্রুতি, তার বাস্তবায়নে সুরক্ষিত জলাঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। সেই লক্ষ্যে সবার আগে দরকার ‘সুরক্ষিত জলাঞ্চল’ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি, আইন, কর্তৃপক্ষ ও ব্যবস্থাপনার বিধিমালা স্থির ও জারি করা। বাংলাদেশে এ যাবত যদ্দুর সম্ভব কার্যকর রাষ্ট্রীয় পরিবেশ সংস্থা- পরিবেশ অধিদপ্তরের নেতৃত্বে এটা শুরু করা যেতে পারে।  

পরিবেশ অধিদপ্তরকে একটি কার্যকর রাষ্ট্রীয় পরিবেশ সংস্থা হিসেবে রূপ দেয়া জরুরি। বছরের পর বছর ধরে এটা হয় নি। এখন গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রতিবেশ সুরক্ষার কাজটি সামনে রেখে এই প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা দরকার। গবেষণা, ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিযুক্ত করা দরকার। সেই লক্ষ্যে দরকারি নীতিগত ও অবকাঠামো সংস্কার জরুরি।

পরিবেশ অধিদপ্তরকে সামুদ্রিক পরিবেশ বিষয়ক স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত সুরক্ষিত জলাঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনার উদ্যোগকে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়ার কাজ শুরু করা দরকার। নয়তো, ‘প্রতিবেশগতভাবে সঙ্কটাপন্ন এলাকা’র মত সুরক্ষিত জলাঞ্চলের উদ্যোগও জলে যেতে পারে।

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সেভ আওয়ার সি
arju@ saveoursea.social

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।