ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৪ জুলাই ২০২৫, ২৮ মহররম ১৪৪৭

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী

আবু তালহা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৫৬, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা, চাঁদপাই এবং শরণখোলা রেঞ্জের মধ্যে কটকা জেটির পাশে ওয়াচ-টাওয়ার সবচেয়ে উঁচু। এখানে উঠলে সামনের খোলা ভূমিতে দেখা যাবে পাল পাল হরিণ।

কচিখালী, শরণখোলা রেঞ্জ, সুন্দরবন থেকে: খুলনা, চাঁদপাই এবং শরণখোলা রেঞ্জের মধ্যে কটকা জেটির পাশে ওয়াচ-টাওয়ার সবচেয়ে উঁচু। এখানে উঠলে সামনের খোলা ভূমিতে দেখা যাবে পাল পাল হরিণ।

এর ঠিক আগেই রয়েছে একটি মিঠাপানির পুকুর- হরিণ, বাঘ ছাড়াও অন্যান্য বন্যপ্রাণী এখানে জল খেতে আসে।

টাওয়ার থেকে পূবে কটকা-কচিখালী সমুদ্র সৈকতের দিকে যত যাওয়া যাবে- ততই ঘন হয় আসবে বন, সরু হয়ে যাবে ট্রেল। বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এদিকটায় হরিণ, বাঁদর যেমন বেশি- তেমন বাঘের সংখ্যাও বেশি। খোলা ভূমির লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে তাই সজাগ দৃষ্টিতে এগুতে হয়। জামতলী হয়ে গহীন বনের ভেতর দিয়ে সরু পথ গিয়ে উঠেছে কটকা সৈকতে। সেখান থেকে বাঁ-দিকে সৈকত ধরে ঘণ্টা দুই হাঁটলে কচিখালী।

এক ঘণ্টার ট্রেলের দু’পাশে কেওড়া, বরই, তাল, অশ্বথ গাছের সারি। মাঝে মাঝে অশ্বথের শেকড় নেমে তৈরি করেছে প্রাকৃতিক দরজা। বনে অভিযানের এমন অনুভূতি তিন রেঞ্জে আর কোথাও পাওয়ার সুযোগ নেই!

তবে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। জেলে, মৌলে, কাঠুরিয়ারা সুন্দরবনে বাঘ, বনদস্যু, জলদস্যুর চেয়ে বেশি ভয় পায় দেও-দানব, ভূত। এ বনে জনশ্রুতি রয়েছে কাউকে একবার বাঘে খেয়ে ফেললে সে ‘বাঘভূত’ হয়ে জন্ম নেয়। তার প্রেতাত্মা জঙ্গলে বাঘের রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়- মানুষের অপেক্ষা করে। যদি কোনো মানুষের দেখা পায়, তাহলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে মারতে পারলেই ‘ভূত জন্ম’ থেকে মুক্তি মিলবে। তাই জঙ্গলে মানুষ মধু বা কাঠ আনতে ঢুকলে সেই প্রেতাত্মা মানুষের সুরে অবিকল ডাকতে থাকে। এ জন্য জঙ্গলে কেউ কারও নাম ধরে ডাকে না। ডাকে ‘কু’ বলে। একজন বলবে ‍কু এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন উত্তর দেবে কু। সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে এই বিশ্বাস সবচেয়ে প্রবল। বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাঘ এবং বাঘভূতের কবল থেকে বাঁচতে তাই “বনের হরিণ যত খোদার ফরমানে। বনবিবিকে পারওয়ারেশ করে সেই বনে” স্মরণ করা হয় লৌকিক দেবী বনবিবিকে।

কেবল বাঘের ভয় নয়, সৈকতের কাছাকাছি পৌঁছালে ঢেউ ভাঙার শব্দ জানান দেবে সাগর এখানে কতটা ক্ষেপে রয়েছে!মাঝিরা বলে, জোয়ারের সময় তিন ঢেউয়ে কটকা সৈকত ভরে যায়। সাগর এখানে তুলনামূলক অগভীর হওয়ায় তেমনই মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। মূল ভয়টা হলো চোরাবালি।

বন বিভাগ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সতর্কিকরণ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে রেখেছে ‘কটকা একটি বিপদজনক সমুদ্র সৈকত/ সৈকতের পানিতে না নামার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে’। বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এ পথে ভয়টা যত বেশি, এখানখার সৌন্দর‌্যও তত বেশি। সোজা পথে বন পেরিয়ে সৈকতে উঠতেই পাইন গাছের সারি দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। সৈকতে ঢেউয়ের সঙ্গে সাগর কালো বালি তুলে আনলেও পাইন গাছের গোড়ায় জমা করেছে ধবধবে সাদা বালি। বাঁ-দিকে যতদূর চোখ যায় সমুদ্র সৈকত।

কাটকা-কচিখালী সৈকত জুড়ে ছোট ছোট কাঁকড়ার বাস, পায়ের আওয়াজ পেলেই ঢুকে যায় গর্তে। এদের একেকটির একেক বৈশিষ্ট্য। কোনোটি গর্ত খোঁড়ার সময় মাটি উঠে হয়েছে আল্পনা, কোনোটির চলায়।

এই সৈকতে ভোর বেলা পানি খেতে আসে বাঘ, হরিণ, বাঁদর, বন্য শূকর আরও অনেক প্রাণী। হেঁটে কচিখালী যেতে পথে বাঘ এবং অন্যান্য প্রাণীদের মুখোমুখী হয়ে যাওয়ার তাই সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে দলবদ্ধ হয়ে থাকলে কোনো ভয় নেই। বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিপদজনক, দৃষ্টিনন্দন সৈকত কটকা-কচিখালী-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাঘ দেখার নেশায় সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। পাইন গাছের সারি পার হতেই বাঁ-দিকে শুরু হলো শনবন।   আরও কিছু দূরে সৈকতের বালিতে হরিণের পায়ের ছাপ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেলো ঠিক পথে এগুচ্ছি আমরা। এরপরই মিললো বাঘের পায়ের ছাপ! বনরক্ষী সুজিত বললেন শনবনের দিকে গেছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করলাম- ভেতরে গেলে দেখা মিলতে পারে।

বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে আমরা সামনে এগুতে শুরু করলাম। কিছু দূর যাওয়ার পরে আরও দু’টি ছাপ, বোঝা গেলো বাচ্চা দিয়েছে মা বাঘ। অর্থাৎ বাচ্চাসহ মোট তিনটি বাঘ রয়েছে এ অঞ্চলে। কচিখালীর উদ্দেশে আমরা হাঁটতে থাকলাম। গজ পাঁচেক যাওয়ার পরে আরও দু’টি বাঘের পায়ের ছাপ- সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচ। বনরক্ষীর মতে, দু’টি বাচ্চা-দু’টি মা এবং একটি পুরুষ বড় আকারের বাঘ হেঁটে গেছে এ পথে।

বাচ্চা দেওয়ার পরে মা বাঘ হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। তাই শনবনে ঢোকার পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হলো। সৈকত ধরে যত সামনে যাওয়া যায়, সৌন্দর‌্য যেনো পথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম কচিখালী। সেখান থেকে গন্তব্য সুমতিখাল। ভাগ্য ভালো হলে ট্রলারে বসেই দেখা যায় চেনা-অচেনা অসংখ্য পাখি, বাঘ এবং কুমির।
সহযোগিতায়

সহযোগিতায়


আরও পড়ুন...

** মুহূর্তেই বন্ধু হয়ে ওঠে কটকার হরিণ-বাঁদর
** বিপদের কাণ্ডারী বদর কবুতর
** দুবলার চরে নাম সংকীর্তন-ভাবগীতে খণ্ডকালীন জীবন
** বাঘের পায়ের ছাপ সন্ধানে ওয়াকওয়ে ধরে দেড় কিলোমিটার
** মংলা পোর্টে এক রাত
** বিস্মৃতির অতলে বরিশালের উপকথা​
**‘জোনাকি’ ভরা বুড়িগঙ্গা

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ